এক লাফে রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমলো চার লক্ষ। ১১ লক্ষ থেকে সাত লক্ষ। কী কারণে স্কুলছুট হলো এই বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া?
আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে মাধ্যমিক পরীক্ষা। তার আগে ড্রপ আউটের ভয়াবহ ছবি সামনে এসেছে। ২০২২ সালে ১০ লক্ষ ৯৮ হাজার ৭৭৫ জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল। এবার দশম শ্রেণির চূড়ান্ত এই পরীক্ষা দেবে ৬ লক্ষ ৯৮ হাজার ৬২৬ জন। অর্থাৎ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৪০ শতাংশ।
২০২১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় চোখ রাখলে ছবিটা আরো করুণ হয়ে ওঠে। মাধ্যমিকের রেজিস্ট্রেশন নবম শ্রেণিতেই সম্পন্ন হয়। পরে দশম শ্রেণিতে চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ফর্ম ফিলাপ করতে হয়। ২০২১-এ ১১ লক্ষ ১২ হাজার পড়ুয়া রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিল। কম্পার্টমেন্টাল মিলিয়ে আরো দু’লক্ষ পড়ুয়া থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষার জন্য ফর্ম পূরণ করেছিল ১১ লক্ষের কম পড়ুয়া।
পরপর দু’বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে একই প্রবণতা দেখা যাওয়ায় শিক্ষা মহলের একাংশ এর জন্য ড্রপ আউটকে দায়ী করছে। অর্থাৎ ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসছে না। পড়াশোনা সঙ্গে তাদের যোগ থাকছে না।
অতিমারির জেরে সমাজের একাংশের মানুষের রোজগার কমে গিয়েছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট পরিবারের ছেলেমেয়েরা কাজে নেমে পড়েছে। ফলে তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি।
মাসের পর মাস স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক ছাত্রীর বিয়েও হয়ে গিয়েছে। এই নাবালিকারা বিয়ের পর আর পড়াশোনায় ফিরতে পারেনি। কন্যাশ্রী প্রকল্পে যে সাড়া পাওয়া গিয়েছিল, ড্রপ আউটের ফলে কি তার দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাচ্ছে না নারী সমাজ?
মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় পরীক্ষার্থী কমার জন্য অতিমারিকেই দায়ী করেছেন। লকডাউনের সময় যারা অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়ত, তারা এবারের পরীক্ষার্থী। অনেকে পরীক্ষা দিচ্ছে না প্রস্তুতির অভাবে। কেউ আবার টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করেনি। করোনার সময় অনলাইন পাঠদানের যে ব্যবস্থা হয়েছিল, তা পর্যাপ্ত ছিল না, তা বোঝা যাচ্ছে পর্ষদ সভাপতির বক্তব্যে।
এর পাশাপাশি ‘ডিজিটাল ডিভাইড’কে দায়ী করা হচ্ছে বৈষম্যের জন্য। করোনাকালে অনলাইন ক্লাসের যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, উপযুক্ত ডিভাইস ও প্রত্যন্ত এলাকায় নেটওয়ার্কের অভাবে অনেকেই তার সুবিধা নিতে পারেনি। এতে বিরূপ ফলও হয়েছে বলে মত প্রধান শিক্ষকদের একাংশের।
অ্যাডভান্স সোসাইটি অফ হেডমাস্টার এন্ড হেডমিস্ট্রেস-এর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক চন্দন মাইতি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ”একদিকে স্কুলে শিক্ষক না থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর অনাস্থা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে মোবাইলে আসক্তি বেড়েছে। ছাত্ররা লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মেধাবী পড়ুয়ারাও এর শিকার হয়েছে।”
রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। এ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় একগুচ্ছ মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন। তার উপর ‘উৎসশ্রী’ প্রকল্পে শিক্ষকদের বদলির ফলে গ্রামের বহু স্কুলে পড়ানোর কেউ নেই।
শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী প্রতি ৩০ জন ছাত্রপিছু একজন শিক্ষক থাকার কথা। অনেক ক্ষেত্রে ১০০ জন ছাত্রপিছু একজন শিক্ষকও নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চ-এর পক্ষে প্রধান শিক্ষক কিংকর অধিকারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ”করোনার কারণ ছাড়াও শিক্ষকের অভাবের ফলে অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েকে বেসরকারি স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রস্তুতির ঘাটতি মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন ছিল।” রাজ্য সরকার সম্প্রতি নয়া নির্দেশিকা জারি করেছে যাতে শিক্ষকের অভাব দূর হয়।
সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার এই ছবির জন্য রাজ্যই দায়ী বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদদের একাংশ।শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের মন্তব্য, ”প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু অতিমারির পর রাজ্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় শিক্ষার মান তলানিতে ঠেকেছে।”
শুধু কোভিডের জেরে এই পরিস্থিতি বলে মনে করেন না শিক্ষাবিদ রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী। তাঁর মতে, ”গত বছর এ কথা বলা যেত। এ বারের পরীক্ষার অনেক আগে স্কুল খুলে গিয়েছে। শিক্ষক না থাকা একটা কারণ। তাই এই বছর করোনার ঘাড়ে দোষ চাপালে হবে না।”
এই বিতর্ক বলে দেয়, একাধিক কারণ রয়েছে ড্রপ আউটের। তার নির্যাস এটাই, এর ফলে বিত্তবান ও বিত্তহীনের মধ্যে ব্যবধান আরো বাড়লো। গত এক বছরের বেশি সময়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুতির অভাব পূরণের চেষ্টা করা যেত। কিন্তু স্কুলে হাজার হাজার শূন্যপদ থাকলে পড়াবেন কে?
ডয়চে ভেলে