০১:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ঋণখেলাপি আর অর্থপাচারকারী তো একই মানুষ

এস. এ টিভি
  • আপডেট সময় : ০৫:১৯:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ নভেম্বর ২০২২
  • / ১৫৩০ বার পড়া হয়েছে

ছবি- সংগৃহীত

এস. এ টিভি সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

‘খুব ঠেকে না গেলে আইএমএফের দেওয়া কঠিন শর্তে কেউ ঋণ নেয় না। আর বাংলাদেশের এখন এই ঋণ না নিয়ে উপায়ও ছিল না।’

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত।

তিনি বলেন, ‘আমাদের রিজার্ভের অবস্থা নিয়ে মিথ্যা বলা হতো। আইএমএফ সব সময়ই বলেছে, রিজার্ভের যে হিসাব দেখানো হয় সেই হিসাবে অন্তত ৮-১০ বিলিয়ন ডলার দেখানো যাবে না। বিনিয়োগ করা এই অর্থ তো আপনি চাইলেই পাবেন না। এক পর্যায়ে এসে যখন রিজার্ভ কমতে শুরু করলো, তখন সত্য কথা বলেছে।’

দেশের বর্তমান ট্রেন্ড বদলে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই ২টি পথেও যখন রিজার্ভ না বাড়ে, তখন ঋণ করতে হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের ঋণ তো বিরাট অংকের, ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা বা এর আশেপাশে এর অংক। অভ্যন্তরীণ ঋণ আর কত নেবেন। এখন নিতে হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো সংস্থা থেকে। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে অর্থনীতির ভেতরের শক্তিটা আর কোথায়।’

বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপের কয়েকটি মানদণ্ড ঠিক করে নেওয়া হলে এবং তার ওপর ভিত্তি করে সঠিক তথ্যে বিচার করা হলে আমি বলব, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না।’

দেশের প্রবৃদ্ধি এবং জিডিপির আকার সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হয় সে বিষয়েও সন্দেহ পোষণ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কেউই হিসাব করে এই তথ্যের সত্যতা দেখাতে পারে না। আর আমাদের প্রবৃদ্ধি কীসের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়, তার খুব বেশি গুরুত্ব আছে বলে আমার মনে হয় না। গুরুত্বপূর্ণ সেটা, যেটা চোখে দেখা যায়। চোখে দেখতে পাচ্ছি, দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বাড়ছে। কেবল বক্তৃতায় বলা হয়, দাম কমে যাবে, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে আছে নাকি অনিশ্চয়তায়, সেটা বুঝতে হবে। ঝুঁকির পরিমাপ করা যায়, কিন্তু অনিশ্চয়তার পরিমাপ করা যায় না। আমাদের অর্থনীতি রয়েছে অনিশ্চয়তায়।’

নিজের দাবির সপক্ষে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমত দ্রব্যমূল্য। অর্থনীতির কোনো সূত্রই বর্তমানে বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে কাজ করছে না। আগামীকাল বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেটা কেউই বলতে পরছে না। একটা সময় তো সেটা বলা যেত। এখন যেহেতু বলা যায় না, তার অর্থ নিশ্চই কিছু একটা হয়েছে। আমরা দাম বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেটের দায় দিতাম। এখন সিন্ডিকেটগুলোও বলছে, দাম কেন বাড়ছে তারা বুঝতে পারছে না। তার মানে হচ্ছে, সিন্ডিকেটের ওপরও মহাসিন্ডিকেট আছে।’

‘দ্বিতীয়ত রিজার্ভ। অনেক অর্থনীতিবিদ বলেন, ৩ বা ৪ মাসের আমদানির সমপরিমাণ রিজার্ভ থাকলে সেটা ভালো পরিমাণ রিজার্ভ। এখানে প্রথম প্রশ্ন, এমন হিসাব কোথায় পাওয়া গেছে এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, ৪ মাসে কত টাকার আমদানি হবে সেই তথ্য নিশ্চিত করে কে বলতে পারে? এখন যে হিসাবে বলবো ৫ মাসের আমদানির টাকা আছে, আমদানির পরিমাণ বেশি হয়ে গেলেই তো মাসের সংখ্যা কমে যাবে। আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে গেলে রপ্তানিতে তার প্রভাব পড়ে। কারণ আমদানিকৃত পণ্যের একটি অংশ রপ্তানির জন্য প্রস্তুত হয়।’

‘তৃতীয়ত, গত দেড়-২ বছরে নাকি আমাদের ২ লাখ মানুষ প্রবাসে গেছেন কাজ করতে। সেই অনুপাতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসছে না, চলে যাচ্ছে হুন্ডিতে। ডলারের দামে যে মারপ্যাচ রয়েছে, সেখানে বাজারের সঙ্গে হুন্ডির বাজারের দামে পার্থক্য ২-৩ টাকার বেশি হলেই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসা বেড়ে যায়। পার্থক্য যখন বেশি হয়, তখন কোনো পাগলও নিজের কষ্টার্জিত অর্থ বাড়িতে পাঠানোর সময় কম যেখানে পাওয়া যাবে সেই পথে পাঠাবে না,’ যোগ করেন তিনি।

অবৈধ পথে রেমিট্যান্স যারা পাঠাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে আবুল বারকাত বলেন, ‘নিজের জমি বিক্রি করে যারা মধ্যপ্রাচ্যে বা অন্য কোনো দেশে কাজ করতে গেছেন, তাদেরকে সরকার ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু যাদেরকে ভয় দেখানো দরকার, তাদেরকে দেখাতে পারেনি। বাংলাদেশে ব্যাংকের ১২ হাজার ব্রাঞ্চ আছে, যার মধ্যে ১০ শতাংশ বা ১ হাজার ২০০টির মতো এডি ব্রাঞ্চ। এমন প্রতিটি ব্রাঞ্চে ৫-৭ জন দালাল আছে, যারা কারসাজি করে। যার অর্থ, পুরো প্রক্রিয়ার সর্ষের মধ্যেই আছে ভূত।’

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি হলে চেষ্টা করতাম ডলারের দরের সঙ্গে হুন্ডির দরের পার্থক্য কমিয়ে আনার।’

আইএমএফের ঋণ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কোনো দেশ উন্নতি করেছে, এমন উদাহরণ নেই। আর্জেন্টিনার কথাই বলি। তাদের মূল্যস্ফীতি ১৫০-২০০ শতাংশে পৌঁছে গেলে আইএমএফের ঋণ নিয়েছিল। এরপরই তাদের মূল্যস্ফীতি ১ হাজার ৮০০ শতাংশে পৌঁছে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেকগুলো মেগাপ্রজেক্ট হয়েছে এবং হচ্ছে, যেগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। ২০২৭ সাল থেকে ৪ থেকে ৫টি মেগাপ্রজেক্টের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। টাকা ছাপিয়ে এই টাকা শোধ করা যাবে না, পরিশোধ করতে হবে ডলারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যদি কমতে থাকে, তাহলে এসব ঋণ পরিশোধ করা হবে কীভাবে? এটাতো খুব সহজ পাটিগণিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের সময় রিজার্ভ বাড়বে— এমন ভবিষ্যৎবাণী করতে যে ট্রেন্ড দরকার সেটা কি আছে? রিজার্ভ বাড়তে হলে ডলারের বিনিময় হারে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে হবে, হুন্ডির মতো লেনদেন কমাতে বা বন্ধ হতে হবে।’

‘রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়সহ রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন তেমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না’ উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘অনেকে হয়তো বলবেন, দেশের যেসব মেগাপ্রজেক্ট হচ্ছে সেখান থেকে অর্থ ফেরত আসবে। তাদেরকে আমি বলব, এগুলো থেকে কবে থেকে অর্থ ফেরত আসতে থাকবে এবং তার পরিমাণ কত সেই হিসাবটাও আমাকে কেউ দেবেন দয়া করে। পদ্মা সেতুতে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে তার টাকা উঠে আসতে ২৫ বছর বা তার বেশি সময় লাগবে। আর যদি ওই দিকের জেলাগুলোতে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন করা হয় তাহলে হয়তো আরও আগে এই টাকা উঠে আসতে পারে। অন্যান্য মেগাপ্রজেক্টগুলো থেকেও অর্থ ফেরত আসা শুরু হতেও অনেক সময় লাগবে।’

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। এমন পরিসংখ্যানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সামনে ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি। বর্তমান ট্রেন্ড অনুযায়ী চলতে চলতে রিজার্ভ যদি ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়, তাহলে সেটা অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামার আশঙ্কা একেবারে অমূলক না। আমি প্রতিমাসের স্টেটমেন্ট দেখে সেই অনুযায়ীই এই আশঙ্কা করছি।’

দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি এবং তা থেকে উত্তরণে সরকারের নেওয়া সম্ভাব্য উদ্যোগের বিষয়ে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে সামনে এমন উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে যে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে মাসে ১০ হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না। অনেক দেশে এমন হয়েছে। এজন্য আমি অনেককে পরামর্শ দেই, পরিবারের সবার নামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে। তাহলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যাবে। এমন উদ্যোগ নেওয়া হবেই, তা বলছি না। কিন্তু বর্তমান ট্রেন্ড দেখে এই পরামর্শ আমি দেই।’

দেশের কালো টাকা এবং অর্থপাচার বিষয়ে আবুল বারকাত বলেন, ‘বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর যদি ঠিকভাবে অডিট করা হয়, তাহলে দেখা যাবে অন্তত ৫০ শতাংশই দেউলিয়া। প্রশ্ন আসবে, তাহলে ব্যাংকগুলো কীভাবে এখনো টিকে আছে। পরস্পর পরস্পরের কাছে কালো টাকা রাখার জায়গাসহ কিছু কারণে এগুলো টিকে আছে। এত সমস্যায় এতগুলো ব্যাংক এত ছোট দেশে লাভজনকভাবে চলতে পারার আর কোনো কারণ নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমি হিসাব দিয়েছে, যেটা কেউ কোনোদিন চ্যালেঞ্জ করেনি, বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে কালো টাকার পরিমাণ ৯০ থেকে ৯৫ লাখ কোটি টাকা। গত ৫০ বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। দেশের ঋণখেলাপি যারা আর অর্থপাচার যারা করছে, তারা তো একই মানুষ।’

আবুল বারকাত বলেন, ‘এখন কোনো বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে না পারলে একটি সাধারণ উত্তর প্রস্তুত থাকে, সেটা হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিকভাবে নিচে নেমে গেছে। মধ্যবিত্ত যারা আছে, তারাও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে কি না সেটা দেখতে হবে। দেশের গরীব মানুষের কথা আর নাইবা বলি, কারণ তারা কষ্টে ছিল, কষ্টে আছে। গরীব মানুষ নিয়ে আমার একটা কথা আছে, দারিদ্র হচ্ছে এমন এক অপরাধের শাস্তি যে অপরাধ তারা করেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ক্যানসার, কার্ডিয়াক, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগের কারণে প্রতি বছর অন্তত ৫০ লাখ অদরিদ্র মানুষ দরিদ্র হচ্ছে।’

২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক আবুল বারকাত। সেসময় তিনি কি করেছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবসময় পেরেছি, তা বলবো না। কারণ, যে সিস্টেমের মধ্যে চেষ্টা করেছি, সেই সিস্টেমে সবকিছু পারা যায় না। কিন্তু এটা সত্য, ২০০৯ সালে যখন দায়িত্ব নিলাম, তখন ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। অথচ, ২০১৩ সালে তৎকালীন সবগুলো ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপারেটিং প্রফিট, নেট প্রফিট এবং সিএসআর করে জনতা ব্যাংক। আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় খেলাপি ঋণ দেখতাম ১২-১৪ শতাংশ, সেটা ৯ শতাংশের কাছাকাছি নামিয়েছিলাম। ২০১৪ সালে আমি দায়িত্ব ছাড়ি। এরপর থেকে আবার খেলাপি ঋণ বেড়ে এখন তো অনেক বেশি হয়ে গেছে। যারা বড় খেলাপি তাদেরকে বড় অংকের ঋণ দেওয়া শুরু হয় আমি দায়িত্ব ছাড়ার পরে। আমি দায়িত্বে থাকাকালীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য একজন ঋণ চেয়েছিলেন, অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, আমি দেইনি। পরবর্তীতে তিনি জনতা ব্যাংক থেকেই ঋণ পান এবং সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র আর হয়নি। পুরো টাকাটাই খেলাপি।’

সূত্রঃ ডেইলি স্টার

এস. এ টিভি সমন্ধে

SATV (South Asian Television) is a privately owned ‘infotainment’ television channel in Bangladesh. It is the first ever station in Bangladesh using both HD and 3G Technology. The channel is owned by SA Group, one of the largest transportation and real estate groups of the country. SATV is the first channel to bring ‘Idol’ franchise in Bangladesh through Bangladeshi Idol.

যোগাযোগ

বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬,
গুলশান-১, ঢাকা-১২১২,
বাংলাদেশ।
ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০
ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪
ই-মেইল: info@satv.tv
ওয়েবসাইট: www.satv.tv

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৩। বাড়ী ৪৭, রাস্তা ১১৬, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ। ফোন: +৮৮ ০২ ৯৮৯৪৫০০, ফ্যাক্স: +৮৮ ০২ ৯৮৯৫২৩৪

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ঋণখেলাপি আর অর্থপাচারকারী তো একই মানুষ

আপডেট সময় : ০৫:১৯:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ নভেম্বর ২০২২

‘খুব ঠেকে না গেলে আইএমএফের দেওয়া কঠিন শর্তে কেউ ঋণ নেয় না। আর বাংলাদেশের এখন এই ঋণ না নিয়ে উপায়ও ছিল না।’

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত।

তিনি বলেন, ‘আমাদের রিজার্ভের অবস্থা নিয়ে মিথ্যা বলা হতো। আইএমএফ সব সময়ই বলেছে, রিজার্ভের যে হিসাব দেখানো হয় সেই হিসাবে অন্তত ৮-১০ বিলিয়ন ডলার দেখানো যাবে না। বিনিয়োগ করা এই অর্থ তো আপনি চাইলেই পাবেন না। এক পর্যায়ে এসে যখন রিজার্ভ কমতে শুরু করলো, তখন সত্য কথা বলেছে।’

দেশের বর্তমান ট্রেন্ড বদলে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই ২টি পথেও যখন রিজার্ভ না বাড়ে, তখন ঋণ করতে হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের ঋণ তো বিরাট অংকের, ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা বা এর আশেপাশে এর অংক। অভ্যন্তরীণ ঋণ আর কত নেবেন। এখন নিতে হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো সংস্থা থেকে। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে অর্থনীতির ভেতরের শক্তিটা আর কোথায়।’

বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপের কয়েকটি মানদণ্ড ঠিক করে নেওয়া হলে এবং তার ওপর ভিত্তি করে সঠিক তথ্যে বিচার করা হলে আমি বলব, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না।’

দেশের প্রবৃদ্ধি এবং জিডিপির আকার সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হয় সে বিষয়েও সন্দেহ পোষণ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কেউই হিসাব করে এই তথ্যের সত্যতা দেখাতে পারে না। আর আমাদের প্রবৃদ্ধি কীসের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়, তার খুব বেশি গুরুত্ব আছে বলে আমার মনে হয় না। গুরুত্বপূর্ণ সেটা, যেটা চোখে দেখা যায়। চোখে দেখতে পাচ্ছি, দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বাড়ছে। কেবল বক্তৃতায় বলা হয়, দাম কমে যাবে, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে আছে নাকি অনিশ্চয়তায়, সেটা বুঝতে হবে। ঝুঁকির পরিমাপ করা যায়, কিন্তু অনিশ্চয়তার পরিমাপ করা যায় না। আমাদের অর্থনীতি রয়েছে অনিশ্চয়তায়।’

নিজের দাবির সপক্ষে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমত দ্রব্যমূল্য। অর্থনীতির কোনো সূত্রই বর্তমানে বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে কাজ করছে না। আগামীকাল বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেটা কেউই বলতে পরছে না। একটা সময় তো সেটা বলা যেত। এখন যেহেতু বলা যায় না, তার অর্থ নিশ্চই কিছু একটা হয়েছে। আমরা দাম বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেটের দায় দিতাম। এখন সিন্ডিকেটগুলোও বলছে, দাম কেন বাড়ছে তারা বুঝতে পারছে না। তার মানে হচ্ছে, সিন্ডিকেটের ওপরও মহাসিন্ডিকেট আছে।’

‘দ্বিতীয়ত রিজার্ভ। অনেক অর্থনীতিবিদ বলেন, ৩ বা ৪ মাসের আমদানির সমপরিমাণ রিজার্ভ থাকলে সেটা ভালো পরিমাণ রিজার্ভ। এখানে প্রথম প্রশ্ন, এমন হিসাব কোথায় পাওয়া গেছে এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, ৪ মাসে কত টাকার আমদানি হবে সেই তথ্য নিশ্চিত করে কে বলতে পারে? এখন যে হিসাবে বলবো ৫ মাসের আমদানির টাকা আছে, আমদানির পরিমাণ বেশি হয়ে গেলেই তো মাসের সংখ্যা কমে যাবে। আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে গেলে রপ্তানিতে তার প্রভাব পড়ে। কারণ আমদানিকৃত পণ্যের একটি অংশ রপ্তানির জন্য প্রস্তুত হয়।’

‘তৃতীয়ত, গত দেড়-২ বছরে নাকি আমাদের ২ লাখ মানুষ প্রবাসে গেছেন কাজ করতে। সেই অনুপাতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসছে না, চলে যাচ্ছে হুন্ডিতে। ডলারের দামে যে মারপ্যাচ রয়েছে, সেখানে বাজারের সঙ্গে হুন্ডির বাজারের দামে পার্থক্য ২-৩ টাকার বেশি হলেই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসা বেড়ে যায়। পার্থক্য যখন বেশি হয়, তখন কোনো পাগলও নিজের কষ্টার্জিত অর্থ বাড়িতে পাঠানোর সময় কম যেখানে পাওয়া যাবে সেই পথে পাঠাবে না,’ যোগ করেন তিনি।

অবৈধ পথে রেমিট্যান্স যারা পাঠাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে আবুল বারকাত বলেন, ‘নিজের জমি বিক্রি করে যারা মধ্যপ্রাচ্যে বা অন্য কোনো দেশে কাজ করতে গেছেন, তাদেরকে সরকার ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু যাদেরকে ভয় দেখানো দরকার, তাদেরকে দেখাতে পারেনি। বাংলাদেশে ব্যাংকের ১২ হাজার ব্রাঞ্চ আছে, যার মধ্যে ১০ শতাংশ বা ১ হাজার ২০০টির মতো এডি ব্রাঞ্চ। এমন প্রতিটি ব্রাঞ্চে ৫-৭ জন দালাল আছে, যারা কারসাজি করে। যার অর্থ, পুরো প্রক্রিয়ার সর্ষের মধ্যেই আছে ভূত।’

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি হলে চেষ্টা করতাম ডলারের দরের সঙ্গে হুন্ডির দরের পার্থক্য কমিয়ে আনার।’

আইএমএফের ঋণ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কোনো দেশ উন্নতি করেছে, এমন উদাহরণ নেই। আর্জেন্টিনার কথাই বলি। তাদের মূল্যস্ফীতি ১৫০-২০০ শতাংশে পৌঁছে গেলে আইএমএফের ঋণ নিয়েছিল। এরপরই তাদের মূল্যস্ফীতি ১ হাজার ৮০০ শতাংশে পৌঁছে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেকগুলো মেগাপ্রজেক্ট হয়েছে এবং হচ্ছে, যেগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। ২০২৭ সাল থেকে ৪ থেকে ৫টি মেগাপ্রজেক্টের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। টাকা ছাপিয়ে এই টাকা শোধ করা যাবে না, পরিশোধ করতে হবে ডলারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যদি কমতে থাকে, তাহলে এসব ঋণ পরিশোধ করা হবে কীভাবে? এটাতো খুব সহজ পাটিগণিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের সময় রিজার্ভ বাড়বে— এমন ভবিষ্যৎবাণী করতে যে ট্রেন্ড দরকার সেটা কি আছে? রিজার্ভ বাড়তে হলে ডলারের বিনিময় হারে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে হবে, হুন্ডির মতো লেনদেন কমাতে বা বন্ধ হতে হবে।’

‘রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়সহ রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন তেমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না’ উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘অনেকে হয়তো বলবেন, দেশের যেসব মেগাপ্রজেক্ট হচ্ছে সেখান থেকে অর্থ ফেরত আসবে। তাদেরকে আমি বলব, এগুলো থেকে কবে থেকে অর্থ ফেরত আসতে থাকবে এবং তার পরিমাণ কত সেই হিসাবটাও আমাকে কেউ দেবেন দয়া করে। পদ্মা সেতুতে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে তার টাকা উঠে আসতে ২৫ বছর বা তার বেশি সময় লাগবে। আর যদি ওই দিকের জেলাগুলোতে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন করা হয় তাহলে হয়তো আরও আগে এই টাকা উঠে আসতে পারে। অন্যান্য মেগাপ্রজেক্টগুলো থেকেও অর্থ ফেরত আসা শুরু হতেও অনেক সময় লাগবে।’

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। এমন পরিসংখ্যানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সামনে ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি। বর্তমান ট্রেন্ড অনুযায়ী চলতে চলতে রিজার্ভ যদি ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়, তাহলে সেটা অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামার আশঙ্কা একেবারে অমূলক না। আমি প্রতিমাসের স্টেটমেন্ট দেখে সেই অনুযায়ীই এই আশঙ্কা করছি।’

দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি এবং তা থেকে উত্তরণে সরকারের নেওয়া সম্ভাব্য উদ্যোগের বিষয়ে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে সামনে এমন উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে যে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে মাসে ১০ হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না। অনেক দেশে এমন হয়েছে। এজন্য আমি অনেককে পরামর্শ দেই, পরিবারের সবার নামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে। তাহলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যাবে। এমন উদ্যোগ নেওয়া হবেই, তা বলছি না। কিন্তু বর্তমান ট্রেন্ড দেখে এই পরামর্শ আমি দেই।’

দেশের কালো টাকা এবং অর্থপাচার বিষয়ে আবুল বারকাত বলেন, ‘বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর যদি ঠিকভাবে অডিট করা হয়, তাহলে দেখা যাবে অন্তত ৫০ শতাংশই দেউলিয়া। প্রশ্ন আসবে, তাহলে ব্যাংকগুলো কীভাবে এখনো টিকে আছে। পরস্পর পরস্পরের কাছে কালো টাকা রাখার জায়গাসহ কিছু কারণে এগুলো টিকে আছে। এত সমস্যায় এতগুলো ব্যাংক এত ছোট দেশে লাভজনকভাবে চলতে পারার আর কোনো কারণ নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমি হিসাব দিয়েছে, যেটা কেউ কোনোদিন চ্যালেঞ্জ করেনি, বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে কালো টাকার পরিমাণ ৯০ থেকে ৯৫ লাখ কোটি টাকা। গত ৫০ বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। দেশের ঋণখেলাপি যারা আর অর্থপাচার যারা করছে, তারা তো একই মানুষ।’

আবুল বারকাত বলেন, ‘এখন কোনো বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে না পারলে একটি সাধারণ উত্তর প্রস্তুত থাকে, সেটা হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিকভাবে নিচে নেমে গেছে। মধ্যবিত্ত যারা আছে, তারাও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে কি না সেটা দেখতে হবে। দেশের গরীব মানুষের কথা আর নাইবা বলি, কারণ তারা কষ্টে ছিল, কষ্টে আছে। গরীব মানুষ নিয়ে আমার একটা কথা আছে, দারিদ্র হচ্ছে এমন এক অপরাধের শাস্তি যে অপরাধ তারা করেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ক্যানসার, কার্ডিয়াক, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগের কারণে প্রতি বছর অন্তত ৫০ লাখ অদরিদ্র মানুষ দরিদ্র হচ্ছে।’

২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক আবুল বারকাত। সেসময় তিনি কি করেছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবসময় পেরেছি, তা বলবো না। কারণ, যে সিস্টেমের মধ্যে চেষ্টা করেছি, সেই সিস্টেমে সবকিছু পারা যায় না। কিন্তু এটা সত্য, ২০০৯ সালে যখন দায়িত্ব নিলাম, তখন ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। অথচ, ২০১৩ সালে তৎকালীন সবগুলো ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপারেটিং প্রফিট, নেট প্রফিট এবং সিএসআর করে জনতা ব্যাংক। আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় খেলাপি ঋণ দেখতাম ১২-১৪ শতাংশ, সেটা ৯ শতাংশের কাছাকাছি নামিয়েছিলাম। ২০১৪ সালে আমি দায়িত্ব ছাড়ি। এরপর থেকে আবার খেলাপি ঋণ বেড়ে এখন তো অনেক বেশি হয়ে গেছে। যারা বড় খেলাপি তাদেরকে বড় অংকের ঋণ দেওয়া শুরু হয় আমি দায়িত্ব ছাড়ার পরে। আমি দায়িত্বে থাকাকালীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য একজন ঋণ চেয়েছিলেন, অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, আমি দেইনি। পরবর্তীতে তিনি জনতা ব্যাংক থেকেই ঋণ পান এবং সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র আর হয়নি। পুরো টাকাটাই খেলাপি।’

সূত্রঃ ডেইলি স্টার