‘অপরাধে জড়াচ্ছে’ পুলিশ, জনমনে আতঙ্ক
- আপডেট সময় : ১১:১৬:৪৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৩
- / ১৭৩০ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর বেশ কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ বহিস্কার করা হয়েছে কাউকে, কারো বিরুদ্ধে মামলা চলছে৷
আর তাই নতুন করে আলোচনায় আসছে পুলিশ সদস্যদের অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা৷ পোশাক পরে পুলিশের এই ‘অপরাধে জড়িত’ হওয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন৷
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না৷ যে কারণে বার বার পুলিশের কিছু সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আসছে৷
তাছাড়া, ইউনিট পর্যায়ে সুপারভিশনের অভাব দেখা যাচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে৷ বিশ্লেষকদের পরামর্শ, পুলিশের ইমেজ ফেরাতে এই অপারাধের বিচার করতে বিশেষ আইন করা যেতে পারে৷
ভাড়ায় অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ!
ঘটনাটি ৯ অক্টোর রাজধানীর শ্যামপুর দোলাইপাড় এলাকার৷ অভিযোগ আছে, আবুল কালাম নামে এক ব্যবসায়ীর ৫৪ লাখ টাকা ছিনতাইয়ে তারই বড় ভাই মোশাররফ হোসেন পুলিশের এক এএসআইকে ভাড়া করেন৷ তিনি গুলশান থানার এএসআই দোলোয়ার হোসেন৷ তারা পকিল্পনা করে ওই টাকা ছিনতাই করেন৷ এএসআই দেলোয়ার ছিনতায়ের সময় আরো এক পুলিশ সদস্যকে সঙ্গে নিয়েছিলেন৷ ছিনতাইয়ের পর তারা টাকা ভাগ বটোয়ারা করে নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে৷
এই ঘটনায় এএসআই দেলোয়ার এবং এক পুলিশ কনেস্টবলসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকার পল্টনে একটি বেসরকারি ব্যাংকে ঢুকে ২০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে দুই পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ আইএফআইসি ব্যাংকের উপ-শাখায় ওই ঘটনা ঘটে৷ এই ঘটনায় দুই পুলিশ কনেস্টবলের সঙ্গে তাদের তিনজন সোর্সকেও আটক করা হয়েছে৷ ওই দুই কনেস্টবল পুলিশের পোশাক পরেই ছিনতাইয়ে অংশ নেন৷
তারা তাদের সোর্সদের নিয়ে ব্যাংকে ঢুকে একজন গ্রাহককে আটকের নামে তুলে নিয়ে ২০ লাখ টাকা ছিনতাই করেন৷ গ্রাহক পরে মামলা করলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাদের সনাক্ত এবং আটক করা হয়৷ আটক দুই পুলিশ কনেস্টবল ডেমরা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত ছিলেন৷
এদিকে পুলিশ এক এসএআই প্রাইভেট কার ছিনতাই করে গাড়িতে থাকা স্বর্নের বার চুরির সাথে জড়িত তদন্তে এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ ঢাকার গাবতলী থেকে দেড় বছর আগে ছিনতাই হওয়া একটি প্রাইভেট কার থেকে ৩১টি স্বর্নের বার খোয়া যাওয়ার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের এক এসআই-এর জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে৷ গাড়িটি তখন পাওয়া গেলেও স্বর্নের বার উদ্ধার করা হয় গত জুলাই মাসে পুলিশের এসআই আশরাফুল ইসলামের বাসা থেকে৷ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷
গত বছরও কতিপয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে একাধিক ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠেছে৷ গত বছরের ১৭ অক্টোবর মতিঝিলের একটি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে পুলিশ ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই করে৷ তিনজন পুলিশ কনেস্টবল তখন এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের নামে তুলে নিয়ে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই করে৷ ওই তিন পুলিশ কনেস্টবলকেও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চিহ্নিত এবং আটক করা হয়৷
পাঁচ পুলিশ সদস্য ও তাদের সহযোগীরা বিরুদ্ধে ওই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পথে দুবাইফেরত এক যাত্রীর মাইক্রোবাস থামিয়ে পিস্তল ঠেকিয়ে ২২ লাখ টাকার মালামাল ও বিদেশি মুদ্রা ছিনতাই করার অভিযোগ আছে৷ তারা হলেন পুলিশ কনস্টেবল সালাউদ্দিন ও সুমন এবং তাদের সহযোগী তোফাজ্জল, আলী ও সাইফুল৷ তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে৷
গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেনীর সোনাগাজী মডেল থানার এএসআই মো. জহিরুল হক, কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন ও কায়সার হামিদকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে প্রত্যাহার করা হয়৷ তারা শেখ ফরিদ নামে এক ব্যাসায়ীকে ইয়াবা বিক্রেতা আখ্যা দিয়ে অটোরিকশায় তুলে মারধর করেন৷ পরে ব্যবসায়ীর কাছে থাকা দেড় লাখ টাকা ছিনিয়ে নেন৷
ওই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি মোবাইল ফোন ছিনতাই করতে গিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ায় জনতার হাতে ধরা পড়েন আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন) নিরঞ্জন দাস নামে এক সদস্য৷ তিনি ভয় দেখিয়ে এক যুবকের মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছিলেন, এমনটাই অভিযোগ৷
শুধু ছিনতাই নয়, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো, মামলার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মদক দিয়ে মামলা করে টাকা আদায়, অজ্ঞাত আসামির তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দিয়ে অর্থ আদায়, নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়সহ নানা অভিযোগ আছে অনেক দিন ধরেই৷
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বুধবার শ্যামপুরে ৫৪ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘কার কী পরিচয় সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়৷ কেউ অপরাধ করলে আমরা তাকে অপরাধী হিসেবে দেখি৷ তাদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না৷ আগেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কিংবা এই পরিচয় দিয়ে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় জড়িতদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি৷ এখন যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের রিমান্ডে আনা হয়েছে৷ তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ কাউকে ছাড় দেয়া হবে না৷’’
বাড়ছে অপরাধের অভিযোগ, শাস্তি
জানা গেছে, সদর দপ্তরে পুলিশের বিভিন্ন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিবছরই বাড়ছে৷ ২০১৮ সালে ১৪ হাজার ৪০২ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে৷ ২০১৯ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৫১২৷ ২০২০ সালে আরো বেড়ে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার ২১২৷ ২০২১ সালে ১৬ হাজার ৪১৮ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে৷
গত কয়েক বছরের গড় হিসাব করলে দেখা যায় বছর গড়ে ৯ হাজারের মতো পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন অভিযোগে গুরু ও লঘু দণ্ড দেওয়া হয়েছে৷ তবে এই শাস্তির মধ্যে চাকরিচ্যুতি খুবই কম৷ সাধারণভাবে পদাবনয়ন, প্রত্যাহার, বদলি, ভর্ৎসনা এসবের মধ্যেই শাস্তি সীমাবদ্ধ৷ আর শান্তিপ্রাপ্তরা অধিকাংশই এসআই, এএসআই ও কনেস্টবল পদ মর্যাদার৷
ফৌজদারি আইনে মামলার দাবি বিশ্লেষকেরা
পুলিশের সাবেক ডিআইজি ও গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান সৈয়দ বজলুল করিম বলেন, ‘‘পুলিশ সদস্যরা সরাসরি ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে৷ কারণ তারা তো পুলিশ সদস্য এবং পোশাকে থাকা অবস্থায় ছিনতাই করছে৷ ফলে সাধারণ মানুষ তো তাদের প্রথমে চ্যালেঞ্জ বা সন্দেহ করতে পারছে না৷ ফলে তারা অসহায় হয়ে পড়ছে৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘পুলিশে অপরাধ প্রবণতা আরো বেড়ে গেছে৷ এটা হচ্ছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে৷ তাই তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থায় সীমাদ্ধ থাকলে হবে না৷ তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত ফৌজদারি আইনে মামলা করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে৷ প্রয়োজনে বাহিনীর সদস্যদের এধরনের অপরাধের বিচার করতে আলাদাভাবে আরো কঠোর আইন করা দরকার৷ তা না হলে পুলিশের ইমেজ রক্ষা করা যাবে না৷’’
তার কথা, ‘‘পুলিশে সুপারভিশন এবং মোটিভেশনের অভাব আছে৷ ইউনিট পর্যায়ে যদি দায়িত্বশীলরাও এইসব অপরাধকে সমর্থন দেয় তাহলে তো তাদের অধস্তনরা আরো উৎসাহিত হবে৷’’
আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংদসীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ এমপি ভাড়ায় পুলিশ সদস্যদের ছিনতাইয়ের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘‘টাকার বিনিময়ে পুলিশ ছিনতাই করে এটা আমার কাছে নতুন৷ এটা আমার কাছে অভিনব ঠেকছে৷ এই ধরনের ঘটনা আগে শুনিনি৷’’
তিনি বলেন, পুলিশের যে ইউনিটগুলোতে অপরাধ প্রবণতা বেশি সেই ইউনিটগুলোতে সুপারভিশন বাড়ানো দরকার৷ যারা ইউনিটের দায়িত্বে আছেন তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে৷ কোনো পুলিশ সদস্য কোনো অপারেশনে গেলে তাদের জিডি করে যেতে হয়৷ যারা ছিনতাই করলো তাহলে তারা কীভাবে বাইরে গেল৷ তারা জিডি ছাড়া গেলে তো এটা ভয়াবহ ব্যাপার৷’’
তার বক্তব্য, ‘‘এমনিতে পুলিশের ভেতরে অপরাধ প্রবণতা আছে৷ তাদের ছোটখাট অপরাধের জন্য প্রতিবছরই অনেক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ কিন্তু এই ধরনের বড় অপরাধের জন্য শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা যথেষ্ঠ নয়৷’’
ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ