বৈষম্য ও দুর্বৃত্তশক্তির প্রভাব: এনবিআর এর অস্থিরতা ও সমাধানের পথ

- আপডেট সময় : ০৮:৪২:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
- / ১৬৩১ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের স্বনামধন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দীর্ঘদিন ধরে একটি অস্থির ও অপ্রতুল কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়ে আসছে। এর অন্যতম কারণ হলো অভ্যন্তরীণ বৈষম্য, যা বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে এবং এর ফলে কার্যকর শাসন ব্যবস্থা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ব্যাহত হয়েছে।
এই বৈষম্য শুধু অভ্যন্তরীণ কর্মচারীদের মধ্যে নয়, বরং করদাতাদের সঙ্গেও সম্পর্কিত, যেখানে ক্ষমতাধর সিন্ডিকেট ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব অত্যন্ত প্রবল।
বৈষম্য ও তার প্রভাব: সিন্ডিকেটের শক্তি ও প্রভাব: এনবিআরে দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন জোনে চাকরি করেন এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের অঘোষিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরা রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থের প্রভাব এবং শক্তিশালী ব্যক্তিগত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কার্যক্রম চালায়। এর ফলে, কর আইন প্রয়োগে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, কর ফাঁকি দিতেও জিরো টলারেন্স দেখান না, এবং করদাতাদের উপর অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করেন।
বৈষম্য ও ন্যায়বিচার: সিন্ডিকেটের দ্বারা প্রভাবিত কর্মকর্তারা তাদের ক্ষমতার দাপটে কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেন। নারী ও পুরুষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ও অবৈধ বৈষম্য চালু হয়, যেখানে পুরুষ কর্মকর্তারা নারীদের প্রতি অশোভন আচরণ করে থাকেন। আর নারী কর্মকর্তাদের অধীনে অন্য নারীরা চাকরি করতে চান না। তাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক, অপেশাদার ও রুক্ষ আচরণ করেন। একইসঙ্গে, অভ্যন্তরীণ বদলির ক্ষেত্রে যোগ্যতা বা মেধার ভিত্তিতে নয়, সিন্ডিকেটের স্বার্থে বদলি বা পদোন্নতি হয়। এর ফলে, কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে, এবং কাজের মানও কমে যাচ্ছে।
জনদুর্ভোগ ও আন্দোলন: এই বৈষম্য ও স্বার্থান্বেষী কার্যকলাপের কারণে সাধারণ জনগণ ও করদাতাদের মধ্যে ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার অভাব দেখা দেয়। এরই ফলশ্রুতিতে, কর্মচারীরা আন্দোলনে নামেন, কলমবিরতি, অবরোধ বা অন্যান্য কর্মসূচি পালন করেন। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ে এবং সরকারের রাজস্ব সংগ্রহের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। অধিকাংশ সাধারণ কর্মচারী এই পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ, কারণ তারা স্বাভাবিক কাজ করতে পারছেন না এবং তাদের উপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া সাধারণ কর্মচারীরা এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন না দিলেও বাধ্য করা হচ্ছে।
প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা: সিন্ডিকেটের প্রভাব ও বৈষম্যজনিত কারণে প্রশাসনিক অদক্ষতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়মিত তদন্ত, মনিটরিং ও জবাবদিহিতা না থাকায় দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে, রাজস্ব আদায়ে অপ্রতুলতা দেখা দেয়, আর উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাঘাত ঘটে।
সমাধানের পথ: স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো: এনবিআর কে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহামূলক করে তুলতে হবে। সিন্ডিকেট বা ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর প্রভাব কমাতে, কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশদ যাচাই-বাছাই ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।
বৈষম্য দূরীকরণ: কর্মচারীদের মধ্যে বৈষম্য ও অপ্রয়োজনীয় আচরণ বন্ধ করে, সমান সুযোগ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বদলি ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ও সহায়তা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে, মানবাধিকার ও কর্মসংস্থান আইনের প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
শক্তিশালী মনিটরিং ও স্বচ্ছতা: করদাতাদের উপর অযৌক্তিক চাপ ও দুর্নীতি কমাতে, স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে করদাতা ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা করে অনিয়মের সুযোগ কমানো যেতে পারে।
দুর্নীতি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব মোকাবেলা: কর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এড়াতে, পৃথক ও স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক ও মনিটরিং সংস্থা গঠন করা যেতে পারে। করদাতাদের স্বার্থ রক্ষা ও কর ফাঁকি রোধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন: কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির প্রকল্প চালু করতে হবে। কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা ও জবাবদিহিতা পর্যবেক্ষণে পরিমাপযোগ্য সূচক নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার জন্য, এনবিআর এর মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে কেবল একটি প্রশাসনিক কাঠামো নয়, বরং একটি ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার দৃষ্টান্ত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করে, এবং দক্ষ ও পেশাদার কর প্রশাসন গড়ে তুলে, দেশের উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তিকে সুদৃঢ় করা সম্ভব। এতে বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনস্বার্থের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
লেখক: রনজক রিজভী, সিনিয়র সাংবাদিক